গত জুন মাসে সারাদেশে ৪৬৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫২৪ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত আরও ৮২১ জন। নিহতদের মধ্যে ২০৪ জনই মারা গেছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়; যা মোট নিহতের ৩৮.৯৩%।
সোমবার (৪ জুলাই) এক প্রতিবেদনে বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এ তথ্য জানিয়েছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ৯টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫২৪ জনের মধ্যে নারী রয়েছেন ৬৮ জন এবং শিশু ৭৩টি। আর মোট ৪৬৭টি দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি; যা মোট দুর্ঘটনার ৪২.১৮%।
দুর্ঘটনায় ১০৭ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২০.৪১%। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৮৬ জন, অর্থাৎ ১৬.৪১%।
এই সময়ে ৮টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত, ১৬ জন আহত হয়েছে এবং ৩ জন নিখোঁজ রয়েছে। ১৮টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং ৪ জন আহত হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা তুলনামুলকভাবে বেশি। মারাত্মক এসব দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানিও ঘটে। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হেলমেট নিয়ে মোটরসাইকেল চালকদের সচেতনতার অভাব।
হেলমেট ব্যবহারের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি এড়ানো। কিন্তু আমাদের দেশের মোটরসাইলেক চালকদের অনেকেই হেলমেট ব্যবহারে উদাসীন। তবে রাস্তায় ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হেলমেট পরার কোনো বিকল্প নেই। তাই নিয়ম রক্ষার খাতিরে হলেও অনেকেই সস্তা হেলমেট বেছে নেন। কিন্তু এতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঝুঁকি থেকেই যায়।
মোটরসাইকেল সংক্রান্ত সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বাংলাদেশের জন্য একটি হেলমেট নীতি কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। মোটরসাইকেলের হেলমেটের মান নির্ধারণের জন্য ব্র্যাকের নেতৃত্বাধীন একটি সংগঠন সুপারিশের খসড়া তৈরি করেছে। সরকারের অনুমোদনের পর আর নিম্নমানের হেলমেট অনুমোদিত হবে না।
সোমবার (৪ জুলাই) বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সদর দপ্তরে এ বিষয়ক নীতিমালা সংক্রান্ত একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে। আমলা, পুলিশ ও সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরাসহ সব স্টেকহোল্ডাররা ওই কর্মশালায় অংশ নেবেন।
ব্র্যাকের পরিচালক (সড়ক নিরাপত্তা) আহমেদ নাজমুল হুসাইন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “কর্মশালা থেকে পাওয়া সব পরামর্শকে একত্রিত করে এ বিষয়ক নীতিমালা সংক্রান্ত একটি কাঠামো তৈরি করা হবে। অবিলম্বে আমরা সেটি সরকারের কাছে জমা দেবো।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা নীতিমালায় বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের মানসম্পন্ন হেলমেটের সুপারিশ করেছি, যা খুব বেশি ব্যয়বহুল নয়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মোটরসাইকেল আরোহী শুধুমাত্র ট্রাফিক আইন মেনে চলার স্বার্থে হেলমেট ব্যবহার করেন। এসব হেলমেটের মধ্যে প্লাস্টিকের হেলমেটই মোটরসাইকেল চালকরা বেশি ব্যবহার করেন, যেগুলোর দাম ৬০০ টাকার মতো। অন্যদিকে, খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী জাতিসংঘের মানসম্পন্ন হেলমেটের দাম ১২-২০ মার্কিন ডলার (১,১২০ টাকা থেকে ১,৮৭০ টাকা)।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান তুহিন আবদুল্লাহ বলেন, “হেলমেট সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি মনে করি গরম আবহাওয়ায় কোনো হেলমেট আমাদের জন্য আরামদায়ক নয়। ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলার জন্যই হেলমেট পরছি।”
মোটরসাইকেলে চলাচলের সময়ে জাকির হোসেন এবং তার সন্তান দুজনেই প্লাস্টিকের হেলমেট পরেন। এসব সড়ক দুর্ঘটনায় খুব সামান্য সুরক্ষা দেয়। হেলমেট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, প্রায়শই হেলমেটগুলি চুরি হয়ে যায়। তারা সহজেই পরিবর্তনযোগ্য হেলমেটগুলো ব্যবহারের জন্য বেছে নেন।
রাইড শেয়ারিং পরিষেবা পাঠাও-এর চালক রফিকুল ইসলামের দাবি, রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বাইকারদের নিম্নমানের হেলমেট সরবরাহ করে।
তিনি বলেন, “আমি আমার হেলমেটটি দেড় হাজার টাকায় কিনেছি। কিন্তু এটি মানসম্মত কি-না, তা আমার জানা নেই। কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনাও নেই। তাই আমার কাছে যেটা সাশ্রয়ী মনে হয়, আমি সেটাই ব্যবহার করি।”
বিআরটিএ-এর তথ্যমতে, ঢাকায় প্রায় ১০ লাখ মোটরসাইকেল আরোহীসহ সারা দেশে ৩৬ লাখ মোটরসাইকেল রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৩ লাখ মোটরসাইকেল আরোহীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মাত্র ১০% মোটরসাইকেল চালক এবং যাত্রীর আসনে থাকা ২% আরোহী মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করেন।
এআরআই অনুসারে, প্রায় ৭% মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ঢাকায় এবং ৯৩% ঢাকার বাইরে ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই এসব দুর্ঘটনায় শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় মৃত্যু ও হতাহতের সংখ্যা বেশি।
২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১,১৬৮ জনের মৃত্যু হয়, যা ২০২০ সালে ছিল ১,০৯৭ জন। বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঈদ-উল-ফিতরের ছুটিতে সারাদেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি থাকে। আর তখন অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি হয়।
বুয়েটের এআরআই-এর পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, “একটি মানসম্পন্ন হেলমেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি মৃত্যুর ঝুঁকি ৪০% কমিয়ে দিতে সক্ষম।
দিবালার সাথে কেন চুক্তি হচ্ছে না?
রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যাক্ট ২০১৮ আইনে চালক এবং যাত্রীদের সঠিকভাবে হেলমেট পরার কথা বলা হলেও “সঠিক” এর পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা নেই। নতুন নীতিমালায় হেলমেটের সঠিক ব্যবহার এবং কার্যকর করার প্রক্রিয়ার উল্লেখ থাকবে।
বিআরটিএর পরিচালক (সড়ক নিরাপত্তা) এসকে মো. মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, “সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করতে হেলমেট সংক্রান্ত নীতি ভূমিকা রাখবে কারণ এতে হেলমেটের সঠিক ব্যবহার এবং এর মান বর্ণনা করা হবে। নীতিমালা অনুসরণ করার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে।”
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত ট্রাফিক কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, “বর্তমানে ঢাকায় বেশিরভাগ মোটরসাইকেল চালক এবং যাত্রী হেলমেট ব্যবহার করলেও সেগুলো নিম্নমানের। আমরা তাদের মানসম্পন্ন হেলমেট ব্যবহারে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি।”
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, “হেলমেটের বিষয়ে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) একটি মান আছে। কিন্তু হেলমেটের মান পরীক্ষা করার জন্য তাদের কোনো পরীক্ষাগার নেই। হেলমেট পরীক্ষা করার জন্য তাদেরও বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে।”
বিশ্বের সব উন্নত দেশের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের নিজস্ব হেলমেট পরীক্ষাগার থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “নিম্নমানের হেলমেটের আমদানি রোধে বিএসটিআই-এর একটি হেলমেট টেস্টিং ল্যাব স্থাপন করা উচিত কারণ একটি মানসম্পন্ন হেলমেট মৃত্যুহার কমাতে পারে।”
এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকারি পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিএসটিআই বেসরকারি পরীক্ষাগারে হেলমেটের মান পরীক্ষা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
Leave a Reply